বাংলাদেশের আইনব্যবস্থা (Legal System of Bangladesh) একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফলাফল। এই ব্যবস্থার মূল উৎস ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন রেওয়াজ, মুসলিম শাসনামলের শরীয়তভিত্তিক আইন, এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আমলে প্রতিষ্ঠিত কমন ল’ বা সাধারণ আইনব্যবস্থা। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে এই দীর্ঘ আইনি ইতিহাস নতুন দিগন্তে প্রবেশ করে। আজকের বাংলাদেশের আইনব্যবস্থা মূলত ব্রিটিশ কমন ল’র ধারাবাহিকতা বহন করছে, যদিও এখানে ইসলামি ও প্রথাগত আইনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রাচীন যুগের আইনব্যবস্থা
বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথাভিত্তিক আইন চালু ছিল। তখনকার সমাজব্যবস্থায় রাজা বা স্থানীয় শাসকই ছিলেন আইনপ্রণেতা ও বিচারক।
-
হিন্দু আইন (ধর্মশাস্ত্র): গুপ্ত ও পাল সাম্রাজ্যের সময়ে হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ভিত্তিক আইন প্রচলিত ছিল। “মনুস্মৃতি”, “যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি” প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের বিধান অনুযায়ী ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন পরিচালিত হতো। বিয়ে, উত্তরাধিকার, সম্পত্তি, এবং সামাজিক শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অধিকাংশ বিধান ধর্মীয় নীতির ওপর নির্ভর করত।
-
প্রথাগত বা রেওয়াজভিত্তিক আইন: গ্রামীণ সমাজে স্থানীয় প্রথা ও সামাজিক সিদ্ধান্ত (যেমন পঞ্চায়েত সভা) আইন হিসেবে গণ্য হতো। এই ব্যবস্থায় সামাজিক সম্প্রীতি ও সামঞ্জস্য রক্ষা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।
মুসলিম শাসনামলে আইনব্যবস্থার রূপান্তর
১৩শ শতকের শুরুতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর উপমহাদেশে একটি নতুন আইনব্যবস্থার সূচনা হয়। তখন ইসলামি শরীয়ত আইন প্রশাসনের মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে।
-
শরীয়ত আইন: কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে তৈরি ইসলামি শরীয়ত তখন বিচারব্যবস্থার মূল উৎস ছিল।
-
কাজি আদালত: মুসলিম শাসকেরা বিচারপ্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য কাজি নিয়োগ করতেন। কাজিরা পারিবারিক ও দেওয়ানি মামলা শুনতেন এবং ফৌজদারি অপরাধে শাস্তি দিতেন।
-
রাজ-আদেশ বা সুলতানি আইন: শরীয়ত আইনের পাশাপাশি শাসকের আদেশও ছিল আইন হিসেবে কার্যকর। অনেক সময় রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক বিষয়ে শাসকের ইচ্ছাই ছিল চূড়ান্ত আইন।
মোগল আমলে (১৫২৬–১৭৫৭) বিচারব্যবস্থা আরও সংগঠিত হয়। প্রতিটি প্রদেশে সুবাহদারদের অধীনে কাজি, মোক্তার ও মুতসাদি নামে কর্মকর্তারা বিচারকাজ পরিচালনা করতেন। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় আইন ও স্থানীয় রেওয়াজের মিশ্র প্রভাব তখনও ছিল প্রবল।
ব্রিটিশ শাসনামলে আধুনিক আইনব্যবস্থার ভিত্তি
১৭৫৭ সালের প্লাসির যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করে। এ সময় থেকে বাংলাদেশের আইনব্যবস্থা আধুনিক রূপ নিতে শুরু করে।
-
দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা (Dual System): ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারকাজে কোম্পানির অংশগ্রহণ শুরু হয়। প্রথমে দেশীয় বিচারকগণ দায়িত্ব পালন করলেও, ধীরে ধীরে ইংরেজ বিচারকরা নিয়ন্ত্রণ নেয়।
-
১৮৬১ সালের Indian High Courts Act এর মাধ্যমে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বেতে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় থেকেই বিচারব্যবস্থায় পেশাদার আইনজীবী, আদালতের কাঠামো এবং ন্যায্যতার ধারণা প্রবেশ করে।
-
ব্রিটিশ কমন ল’ এর প্রভাব: ব্রিটিশরা ইংল্যান্ডের কমন ল’ (Common Law) ব্যবস্থা ভারতবর্ষে চালু করে। অর্থাৎ, বিচারকের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আইন বিকাশ পায় এবং পূর্বের নজির (precedent) অনুসারে নতুন রায় দেওয়া হয়।
-
আইন প্রণয়ন ও সংকলন: এই সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করা হয় — যেমন Penal Code 1860 (বাংলাদেশ দণ্ডবিধি), Civil Procedure Code 1908, Criminal Procedure Code 1898, Evidence Act 1872, ইত্যাদি। এসব আইন আজও বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ভিত্তি।
ব্রিটিশ শাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো আইনজীবী পেশার সূচনা। এ সময় থেকে আইন চর্চা একটি সম্মানজনক পেশা হিসেবে গড়ে ওঠে।
পাকিস্তান আমলে আইনব্যবস্থা (১৯৪৭–১৯৭১)
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অংশ হয় এবং “পূর্ব পাকিস্তান” নামে পরিচিত হয়। এই সময় আইনব্যবস্থা মূলত ব্রিটিশ আমলের আইনেই পরিচালিত হয়, তবে ইসলামি আইন প্রবর্তনের কিছু প্রচেষ্টা দেখা যায়।
-
পাকিস্তান সংবিধান ১৯৫৬ ও ১৯৬২ তে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেওয়া হয় এবং ইসলামি বিধানের ভিত্তিতে আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
-
তবে বিচারব্যবস্থার কাঠামো ও আইন প্রয়োগের ধরণ ছিল মূলত ব্রিটিশ কমন ল’ এর অনুসারী।
-
পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রবল; বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা সীমিত হয়ে পড়ে। এর ফলে জনগণের মধ্যে ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা কমে যায়, যা পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়।
স্বাধীন বাংলাদেশের আইনব্যবস্থা (১৯৭১–বর্তমান)
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতার পর নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, যা ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হয়।
সংবিধানের ৭নং অনুচ্ছেদে বলা হয়:
“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ, এবং জনগণের পক্ষে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবে শুধুমাত্র সংবিধান অনুযায়ী গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহ।”
অর্থাৎ, সংবিধানই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন।
সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
-
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ — এই চারটি মূলনীতি রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে নির্ধারিত হয়।
-
মৌলিক অধিকার: নাগরিকদের জীবন, স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ, সমতা, শিক্ষা ও আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়।
-
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে।
বিচারব্যবস্থার কাঠামো
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা মূলত দুই স্তরে বিভক্ত:
১. সর্বোচ্চ আদালত (Supreme Court of Bangladesh) — হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ নিয়ে গঠিত।
২. আঞ্চলিক ও নিম্ন আদালত — দেওয়ানি, ফৌজদারি ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালসমূহ।
এছাড়া প্রশাসনিক ও স্থানীয় আদালত যেমন শ্রম আদালত, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, দুর্নীতি দমন আদালত ইত্যাদি রয়েছে।
আধুনিক যুগের উন্নয়ন ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থা আধুনিকায়নের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে।
-
ই-জুডিশিয়ারি: অনলাইন মামলা দাখিল, ভার্চুয়াল শুনানি এবং আদালতের ডিজিটাল রেকর্ড রাখা শুরু হয়েছে।
-
আইনি সহায়তা কর্মসূচি: দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে আইন সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
-
বিশেষ আইন: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ইত্যাদি আধুনিক আইনের উদাহরণ।
তবে কিছু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে — যেমন বিচারব্যবস্থার ধীরগতি, মামলার জট, দুর্নীতি এবং আইনি সচেতনতার অভাব।
উপসংহার
বাংলাদেশের আইনব্যবস্থা হাজার বছরের ঐতিহ্য ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রাচীন ধর্মীয় আইন থেকে শুরু করে আধুনিক সংবিধানভিত্তিক গণতান্ত্রিক আইনি কাঠামো — প্রতিটি পর্যায় আমাদের সমাজের বিকাশের প্রতিচ্ছবি।
আজকের চ্যালেঞ্জ হলো— বিচারব্যবস্থাকে আরও দ্রুত, স্বচ্ছ ও জনগণবান্ধব করা। আইন যেন কেবল কাগজে নয়, বাস্তব জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে— সেটিই হবে স্বাধীন বাংলাদেশের আইনি ইতিহাসের পরবর্তী সফল অধ্যায়।






Leave a Reply